top of page
Search
মিসেস মিতা কুন্ডূ

রবীন্দ্রসঙ্গীতে তান


“সংসারে যদি উপদ্রব করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো।“......কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আজকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সময় বহু গানেই প্রচুর তান, তারানার “প্রয়োগ” শুনতে পাচ্ছি। যাঁরা এগুলো করছেন তাঁদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর দখল আছে বুঝতে পারি। ওঁরা বোধ হয় রবি ঠাকুরের গানের মধ্যে কত যে রাগ রাগিণী লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পেরে গুরুদেবের গানের শ্রীবৃদ্ধি করতে চাইছেন। অলঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগে গানের শ্রীবৃদ্ধি হতেই পারে, সেটা নিয়ে মতভেদ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হোল গুরুদেব নিজে কেন তাহলে গান গুলোতে তান তারানার ব্যবহার করেন নি? এমন তো নয় যে উনি হিন্দুস্তানী রাগ রাগিণী জানতেন না, বা তান তারানা কখনো শোনেন নি!

গুরুদেবের শৈশবে বিখ্যাত বাঙালি সংগীতনায়ক যদুভট্ট জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে থাকতেন এবং নানাবিধ লোক আসত তাঁর কাছে শিখতে; কেউ শিখত মৃদঙ্গের বোল, কেউ শিখত রাগরাগিণীর আলাপ।[1] গুরুদেব লিখেছেন[2] “আমাদের বাড়িতে গানের চর্চার বিরাম ছিল না। বিষ্ণু চক্রবর্তী ছিলেন সংগীতের আচার্য, হিন্দুস্থানী সংগীতকলায় তিনি ওস্তাদ ছিলেন। ... ছেলেবেলায় যে-সব গান সর্বদা আমার শোনা অভ্যাস ছিল, সে শখের দলের গান নয়; তাই আমার মনে কালোয়াতি গানের একটা ঠাট আপনা-আপনি জমে উঠেছিল। ... কালোয়াতি সংগীতের রূপ এবং রস সম্বন্ধে একটা সাধারণ সংস্কার ভিতরে-ভিতরে আমার মনের মধ্যে পাকা হয়ে উঠেছিল।“ শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ বহু বছর একটানা গুরুদেবের গান ও অভিনয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। উনি বলেছেন “...জটিল ছন্দের বাঁট তান বা কেবল ‘আ’ শব্দ উচ্চারণের দ্বারা আরোহণ, অবরোহণ যুক্ত কোনপ্রকার তান বাংলা গানে ব্যবহার করতেন না।... তিনি নিজে তানের দ্বারা সুরবিস্তারে গান শিখিয়েছেন বা নিজে গেয়েছেন, এমন কখনো শুনিনি। নানারূপ সুরের বিস্তার ও ‘তান’ সমেত গুরুদেবকে নিজের গানে সুর যোজনা করতে দেখিনি।“[3]

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকপাল শিল্পী ও মনিষীদের থেকে গান শেখার। ওঁরাও তো সেভাবে শেখান নি! কেন? তাহলে, গুরুদেব কি ফাঁক রেখে গেছেন, না জেনে, না বুঝে? এবং সেটা এতো দিন কেউ বুঝতে পারেন নি? মানতে পারা যায় কি? দেখা যাক কেন গুরুদেব এমনটি করেন নি? কি ভেবে করেননি?

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সঙ্গীতে প্রধানতঃ দুই ভাবের প্রকাশ। প্রথমতঃ বিশুদ্ধ সঙ্গীত বা উচ্চাঙ্গ সংগীত, দ্বিতীয়তঃ কাব্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ভাব সঙ্গীত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে কাব্য প্রধান নয়। ভাব সঙ্গীতে কাব্য বা ভাবই প্রধান। রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাব সঙ্গীত, বাঙালির অন্তরের সঙ্গীত। কবিগুরুর কথায় “বাণীর প্রতিই বাঙালির অন্তরের টান; সংগীতের সঙ্গে বাণীর মিলন-সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে।“[4] সেই সাধনাকে সফল করতে সঙ্গীতকে জীবন্ত অমর ভাবের উপর স্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রসঙ্গীত “কৌশল প্রকাশের স্থান নহে ভাব প্রকাশের স্থান।”[5] গুরুদেবের মতে “ওস্তাদির চেয়ে বড়ো একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে দরদ। সেটা বাইরের জিনিস নয়, ভিতরের জিনিস।“[6] ১৮৮১ শালে বেথুন সোসাইটিতে “সংগীত ও ভাব” বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন “গায়কেরা সংগীতকে যে আসন দেন, আমি সংগীতকে তদপেক্ষা উচ্চ আসন দিই; তাহারা সংগীতকে কতকগুলা চেতনাহীন জড় সুরের উপর স্থাপন করেন, আমি তাহাকে জীবন্ত অমর ভাবের উপর স্থাপন করি ......আমি গানের কথাগুলিকে সুরের উপরে দাঁড় করাইতে চাই।“[7] ওই অনুষ্ঠানে উনি আরও বলেন “কেবলমাত্র সুরসমষ্টি, ভাব না থাকিলে জীবনহীন দেহ মাত্র; সে দেহের গঠন সুন্দর হইতে পারে কিন্তু তাহাতে জীবন নাই।“[8]

অর্থাৎ গুরুদেব স্বজ্ঞানে জেনে বুঝে ওঁর গানে তান, তারানা ব্যবহার করেন নি। স্রষ্টার মনের ভাব ভাল করে না বুঝে, সৃষ্টির উৎস না জেনে “শ্রীবৃদ্ধি” করার চেষ্টা নেহাত বাতুলতা। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ মহারাজের মতে[9] “যে কোন রচনার বা সেই রচনায় নিবদ্ধ ভাবের সঙ্গে মনের একাত্মতা বা সমতা না এলে ঠিক ঠিক শৈলীর সৃষ্টি হয় না।“ অমর চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বলেছেনঃ “আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সুরপ্রয়োগ কল্পনায় যে বৈশিষ্ট্য তা তাঁর গানে অন্য সুরকারের সুর সংযোজনায় কখনোই ফুটে ওঠা সম্ভব নয়।“[10]

তাই যাঁরা এসব করতে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁদের প্রতিভার দিকে দৃষ্টি রেখে গুরুদেবের একটা উপদেশ তুলে ধরছিঃ “...পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভার অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন। সংসারে যদি উপদ্রব করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো।“[11]

এতে ওঁদের নিজেদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের সাথে সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত ও গুনুগ্রাহীরা “উপদ্রব” থেকে মুক্তি পাবেন। গুরুদেব সম্বন্ধে প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার মান্না দের কয়েকটা কথা দিয়ে শেষ করছি।

References:

[1] “শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সংগীতের স্থান” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফাল্গুন, ১৩৩৫

[2] “আমাদের সংগীত”, ভাদ্র, ১৩২৮;

[3] রবীন্দ্রসঙ্গীত – শান্তিদেব ঘোষ, ৫ম সংস্করণ, পৌষ, ১৩৮৬

[4] “আমাদের সংগীত”, ভাদ্র, ১৩২৮

[5] “সঙ্গীত ও ভাব” জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৮

[6] “বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতশিক্ষা” অগ্রহায়ন, ১৩৩৫

[7] “সঙ্গীত ও ভাব” জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৮

[8] “সঙ্গীত ও ভাব” জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৮

[9] “সঙ্গীতে রবীন্দ্রপ্রতিভার দান” - স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ১৯৮৪

[10] দেশ পত্রিকা, সাহিত্য সংখ্যাঃ “১৯৯১ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত”

[11] জানকীনাথ বসুকে লিখিত পত্র, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৩৮

391 views0 comments

Recent Posts

See All
bottom of page