“তোমাদের কাছে আমার মিনতি – তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি।“......কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ জন্মদিনের প্রাক্বালে ওনার নিজের মিনতি তোমাদের কাছে রেখে আমার ব্লগ শুরু করছি।
গান গাওয়া, গান শেখা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন এসেছে, কিছু কিছু উত্তর দেবার চেষ্টাও করেছি, আমার কাছে যারা আসেন তাঁদের। আমার কিছু প্রিয় ছাত্র ছাত্রীর অনুরোধে আজ সবার জন্যে ব্লগ শুরু করছি। আমার ব্লগের সার্থকতা তখনই, যখন তোমাদের ভাল লাগবে আর তোমরা আরও বেশি প্রশ্ন করবে।
আজকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে প্রচুর হইচই চলছে। সবাই গাইছেন বা বলবো গাইবার চেষ্টা করছেন। এটা খুবই আনন্দের এবং সুখের কথা। অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই এতে, অনেকদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ নিজে বলে গেছেন “বাংলাদেশকে আমার গান গাওয়াবই। ...এ না গেয়ে উপায় কি। আমার গান গাইতেই হবে – সব কিছুতেই"। ওনার সেই ভবিষ্যৎ বানী আজ সত্যি হয়েছে। কিন্তু খুব বড় একটা মুস্কিলও হয়েছে। গাইছেন সবাই, বুঝে না বুঝে। পড়ে না পড়ে। ফলে ওনার গানের রস, দরদ, মীড় – এক কথায় ওনার গানের বিশেষত্বটা নষ্ট হতে চলেছে।
দূরদর্শী তিনি, তাই বার বার বলে গেছেন, “আমার গান যাতে আমার ব’লে মনে হয় এইটি তোমরা করো। ........ তোমাদের কাছে আমার মিনতি – তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারিনা। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।“
রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে আজ আমরা বুঝে, না বুঝে ওনার গানের ওপর দিয়ে স্টিম রোলার চালিয়ে চলেছি। ওনাকে সত্যি শ্রদ্ধা করলে ওনার মিনতিটা তো আমাদের রাখা উচিত, নয় কি? আমাদের সযত্নে চেষ্টা করা উচিত ওনার গানের সুরটা যেন ঠিক ঠিক গাইতে পারি।
উনি বলেছেন “সব আমি যোগান দিয়ে গেলুম, ফাঁক নেই।“ উনি তো অনেক কষ্ট করে, যত্ন করে আমাদের জন্যে স্বরলিপি লিখে রেখে গেছেন। আজ থেকে প্রায় ৭৭ বছর আগে (৩০ শে জুন, ১৯৪০) গীতালির অন্যতম উদ্যোক্তা শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ মহাশয়কে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনঃ “বুলাবাবু, তোমার কাছে সানুনয় অনুরোধ – এঁদের একটু দরদ দিয়ে, একটু রস দিয়ে গান শিখিয়ো - এইটেই আমার গানের বিশেষত্ব। তার ওপর তোমরা যদি স্টিম রোলার চালিয়ে দাও, আমার গান চেপ্টা হয়ে যাবে। আমার গানে যাতে একটু রস থাকে, তান থাকে, দরদ থাকে ও মীড় থাকে, তার চেষ্টা তুমি কোরো।“
ওনাকে ভালোবেসে, ওনার সানুনয় অনুরোধটা তো আমরা রাখার চেষ্টা করতে পারি, আমরা স্বরলিপিটা তো অনুসরণ করার চেষ্টা করতে পারি। পুরোটা সঠিক করতে না পারাটা আমাদের অক্ষমতা, অপরাধ নয়। কিন্তু ওনার স্বরলিপি কে উপেক্ষা করে নিজে সুর লাগানোর চেষ্টাটা আমার কাছে অমার্জনীয় অপরাধ।
ওনার গানেই ওনাকে প্রনাম জানিয়ে আজ শেষ করি...